শ্রীকৃষ্ণকে যোগী না ভেবে যদি ঈশ্বর ভাবা হয় তাহলে গীতার শ্লোক স্ববিরোধী এবং গীতা একটি ভ্রান্তি পূর্ণ গ্রন্থ হবে

শ্রীকৃষ্ণ ভক্ত অর্থাৎ বৈষ্ণব আদিরা গীতার সুবিশাল আকারের মাহাত্ম্য তুলে ধরে বলে যে গীতা শ্রেষ্ঠ, গীতাই সব, বেদের থেকেও নাকি গীতা শ্রেষ্ঠ। এরা এই প্রকারের যারা নিজের বাপকে বাদ দিয়ে কাকুকে শ্রেষ্ঠ বলে, গীতা অনুযায়ীই জানা যায় যে শ্রীকৃষ্ণ একজন যোগী ছিল গীতা ১১/৪,৯ শ্লোক এবং গীতার শেষের দিকে অর্থাৎ ১৮ অধ্যায়ের ৭৫ এবং ৭৮ শ্লোক দেখুন সেখানে সঞ্জয় কৃষ্ণ কে 'যোগেশ্বর' বলে কথন করেছে, আর যোগেশ্বর এর অর্থ যোগেন্দ্র, মহাযোগী, শ্রেষ্ঠযোগী। বেদ, উপনিষদ, দর্শনের জ্ঞান না থাকলে জানা যায়না যে যোগী কিরূপ হয়, এই সমস্ত কৃষ্ণ ভক্তরা বেদানুকূল কোনো শাস্ত্র মানেনা, এরা মানে অশ্লীল পুরাণ কাহিনী আর গীতার কয়েকটা শ্লোক পড়ে কৃষ্ণকে ঈশ্বর ঈশ্বর বলে চেল্লায়, গীতায় কৃষ্ণ যে শ্লোক গুলো যোগ যুক্ত মুক্ত আত্মা হিসাবে নিজেকে ঈশ্বর বলেছে সেই শ্লোক ধরে কৃষ্ণভক্তরা কৃষ্ণকে ঈশ্বর বানিয়ে দেয় আর যে শ্লোক গুলোতে কৃষ্ণ নিজেকে ঈশ্বর হতে ভিন্ন মেনেছে সেই সমস্ত শ্লোকের কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নাই, কারণ তারা পুরাণ কাহিনী ছাড়া কোনো বৈদিক শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান রাখেনা। আজ শ্রীকৃষ্ণের ওই গাঢ় ভক্তদের একটু দেখিয়ে দেই যে কৃষ্ণকে ঈশ্বর ভাবলে গীতা কেমন স্ববিরোধী এবং ভ্রান্ত পূর্ন হয়। আসুন দেখি__________
গীতা ৪ অধ্যায়, ৫-৬ শ্লোক
ভগবান বললেন -হে পরন্তপ অর্জুন আমার এবং তোমার বহুজনম অতিত হয়েছে, আমি সে সমস্ত জন্মের কথা মনে করতে পারি তুমি তা পার না।৫।
যদিও আমি জন্ম রহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্ব ভূতের ঈশ্বর তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি স্বীয় মায়ার দ্বারা অবতির্ন হই।৬।
ওপরের দুটি শ্লোক স্ববিরোধী কারণ ওপরের শ্লোকে কৃষ্ণ বলেছে তার অনেক বার জন্ম হয়েছে , কিন্তু দেখুন পরের শ্লোকে কৃষ্ণ বলছে যে আমি জন্ম রহিত অর্থাৎ তার জন্ম হয়না।
গীতা ৯ অধ্যায়, ২৯ শ্লোক
আমি সর্বভূতে সমান ভাবে বিরাজ করি, কেউ আমার প্রিয় নয় ও অপ্রিয়ও নয়।২৯।
গীতা ১৮ অধ্যায়, ৬৫-৬৯ শ্লোক
তুমি আমাতে চিত্ত স্থির কর এবং আমার ভক্ত হও। আমার পুজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়। এই জন্য আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে এই ভাবে তুমি আমাকে প্রাপ্ত হবে।৬৫।
পৃথিবীতে মানুষদের মধ্যে তার থেকে অধিক প্রিয়কারি এবং আমার প্রিয় আর কেউ নেই এবং ভবিষ্যতে কখন হবেও না।৬৯।
ওপরের শ্লোকে কৃষ্ণ বলছে তার কাছে কেও প্রিয়ও নয় এবং অপ্রিয়ও নয়। কিন্তু নিম্নের শ্লোকে কৃষ্ণজী অর্জুন কে প্রিয় বলছে এমন কেন ? কৃষ্ণ দুই ধরনের স্ববিরোধী কথা কেন বলছে গীতায় ? আবার নিচের শ্লোকে বলছে তার মতো প্রিয় কেও হবেনা, উত্তর আছে কি কোনো কৃষ্ণভক্তদের ? এখানেই শেষ নয় আরও আছে আসুন_____
গীতা ৭ অধ্যায়, ৬ শ্লোক
হে অর্জুন! সর্বভূত(জড় ও চেতন) এই উভয় প্রকৃতি হতেই উৎপন্ন বলে জানবে এবং আমি সমস্ত জগতের উৎপত্তি এবং প্রলয়রূপ অর্থাৎ সমগ্র জগতের মূল কারণ।৬।
গীতা ১৮ অধ্যায়, ৪৬ শ্লোক
যে পরমেশ্বর হতে সমস্ত প্রাণীর উৎপত্তি হয়েছে, যিনি এই সমগ্র জগৎ পরিব্যাপ্ত আছেন, সেই পরমেশ্বর কে নিজের স্বাভাবিক কর্মের দ্বারা অর্চনা করে মানুষ সিদ্ধি লাভ করে।৪৬।
ওপরের শ্লোকে কৃষ্ণ বলছে যে কৃষ্ণই সমগ্র জগতের মূল কারণ, কিন্তু পরের শ্লোকে কৃষ্ণ স্বয়ং বলছে যে 'যে পরমেশ্বর হতে সমস্ত প্রাণীর উৎপত্তি হয়েছে, যিনি এই সমগ্র জগৎ পরিব্যাপ্ত আছেন'। বলছি গীতায় ঈশ্বর সংখ্যা কয়টা ? আর কৃষ্ণ একবার নিজেই নিজেকে ঈশ্বর বলছে আবার কৃষ্ণ নিজেই ঈশ্বরকে 'যিনি, সেই' বলে কথন করছে, বলছি গীতার শ্লোক এমন উল্টো পাল্টা স্ববিরোধী কেন ?
গীতা ৯ অধ্যায়, ২৮ শ্লোক
এই ভাবে, আমাতে সমস্ত কর্ম অর্পণ দ্বারা সন্ন্যাসযোগে যুক্ত হয়ে তুমি শুভাশুভ ফলরূপ দ্বারা কর্মবন্ধন হতে মুক্ত হবে এবং এ থেকে মুক্ত হয়ে আমাকেই প্রাপ্ত হবে।
গীতা ১৮ অধ্যায়, ৬২ শ্লোক
হে ভারত! তুমি সর্বত্রভাবে সেই পরমেশ্বরই শরনাগত হও। তার কৃপায় তুমি পরমশক্তি এবং সনাতন পরমধাম প্রাপ্ত হয়।৬২।
ওপরের শ্লোকে কৃষ্ণজী বলছে যে 'আমাকেই প্রাপ্ত হবে'। কিন্তু নিচের শ্লোকটি দেখুন এখানে কৃষ্ণজী বলছে 'তুমি সর্বত্রভাবে সেই পরমেশ্বরই শরনাগত হও। তার কৃপায় তুমি পরমশক্তি এবং সনাতন পরমধাম প্রাপ্ত হয়'। এখানে কৃষ্ণজী 'সেই, তার' বলেছে ঈশ্বরকে অর্থাৎ কৃষ্ণজী এখানে ঈশ্বর কে নিজের থেকে ভিন্ন বলছে, কারণ কি ? উত্তর আছে কোনো ইসকন পাদ ভক্ত ? গীতার মধ্যে কৃষ্ণ এমন স্ববিরোধী কথন করছে কেন ? আসুন আরও দেখি_____
গীতা ১৩ অধ্যায়, ১৪, ১৫,১৬ শ্লোক
তার সর্বদিকে হস্ত, পদ, চক্ষু, মস্তক, কান ও মুখ, কারণ তিনি সমগ্র জগতকে ব্যাপ্ত করে আবৃত বিরাজিত আছেন।১৪।
তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়ের বিষয় সমূহের জ্ঞাতা হয়েও প্রকৃত পক্ষে ইন্দ্রিয় রহিত এবং অনাসক্ত হয়েও সকলের ধারক ও পোষক, নির্গুণ হয়েও সমস্ত গুণের ভোক্তা।১৫।
চর, অচর অর্থাৎ জঙ্গম ও স্থাবর সর্বভূতের ভেতর ও বাইরে এবং স্থাবর-জঙ্গম রূপেও তিনি বিরাজিত। অতি সূক্ষ্ম হওয়া সত্ত্বেও অবিজ্ঞেয়, তিনি জ্ঞানীর অতি নিকটে এবং অজ্ঞানীর অত্যন্ত দূরে।১৬।
এখানে কৃষ্ণজী নিজেই ঈশ্বরকে 'তার' বলছে কৃষ্ণজী বলছে যে 'তার সর্বদিকে হস্ত, পদ, চক্ষু, মস্তক, কান ও মুখ, কারণ তিনি সমগ্র জগতকে ব্যাপ্ত করে আবৃত বিরাজিত আছেন'
অর্থাৎ ঈশ্বর সমস্ত দিকেই ব্যাপক আছে বলে কৃষ্ণজী এমন বলছে, পৌরানিকরা এই সমস্ত শ্লোক দেখে তো ঈশ্বর যে সাকার বানিয়ে দেবে কিন্তু দেখুন কৃষ্ণ ওপরের শ্লোকে বলেছে যে 'তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়ের বিষয় সমূহের জ্ঞাতা হয়েও প্রকৃত পক্ষে ইন্দ্রিয় রহিত ' এখানে কৃষ্ণজী বলছে যে ঈশ্বর প্রকৃত পক্ষে ইন্দ্রিয় রহিত অর্থাৎ ঈশ্বরের কোনো ইন্দ্রিয় নেই তিনি নিরাকার। তা কৃষ্ণ ভক্তরা উত্তর দিতে পারবে যে কৃষ্ণ যখন নিজেই ঈশ্বর তাহলে এখানে কৃষ্ণ কাকে 'তিনি' বলছে ? গীতা এমন কেন স্ববিরোধী উল্টো পাল্টা ?
পৌরানিকরা গীতার ওই শ্লোক গুলো ধরে টানে যে যেখানে কৃষ্ণ বলেছে যে আমিই ব্যাসদেব, আমিই কপিলমুনি, আমিই নারদ, আমিই সামবেদ, আমিই ওঙ্কার, আমিই ইন্দ্র আদি আমিই জগতের ঈশ্বর। গীতার এই সমস্ত বাণী গুলোকে প্রয়োগ করে কৃষ্ণভক্তরা কৃষ্ণকেই ঈশ্বর বানিয়ে দেয়।
কৃষ্ণজী 'আমি' শব্দ দ্বারা বলেছে যে 'আমিই ঈশ্বর, আমিই জগতের মূল কারণ' অর্থাৎ কৃষ্ণই ঈশ্বর, এমন যুক্তি দ্বারা যদি কৃষ্ণকে ঈশ্বর ভাবা হয় তাহলে আমি এদেরই এই যুক্তিতেই ফেঁসে দেবো, দেখুন গীতা ১০/৩৭ শ্লোকে কৃষ্ণ বলেছে যে 'বৃঞ্চীনাম্ বাসুদেব অস্মি পাণ্ডবানাম্ ধনঞ্জয়ঃ' কৃষ্ণ বলেছেন যে 'পাণ্ডবের মধ্যে আমিই ধনঞ্জয়'। এই শ্লোকে কৃষ্ণ স্পষ্ট ভাবে বলেছে যে কৃষ্ণ নিজেই ধনঞ্জয় অর্থাৎ অর্জুন, তাহলে কৃষ্ণ যদি নিজেই অর্জুন হয় তাহলে ফালতু ফালতু যুদ্ধে সময় নষ্ট করে গীতার এতগুলো বাণী অর্জুন বলার কি দরকার কি ছিল ? এখানে তো অবশ্যই বলা যায় যে কৃষ্ণ নিজেই অর্জুন হওয়া সত্ত্বেও গীতার জ্ঞান দেওয়ার নাটক কেন করলো যুদ্ধের মাঠে ? যদি কেউ বলে যে 'কৃষ্ণ মানব জাতিকে জ্ঞান দেওয়ার জন্য এমন করেছিল'। এই কথা বলাও ভুল হবে কারণ কৃষ্ণ যখন নিজেই অর্জুন তাহলে যুদ্ধের মাঠে গীতার জ্ঞান দিয়ে যুদ্ধের সময় নষ্ট করার কোনো মানেই ছিলনা, এই জ্ঞান তো কৃষ্ণজী তাদের বাড়িতে এসেই দিতে পারতো, আর এই (গীতা ১০/৩৭) শ্লোক অনুযায়ী গীতার ওই বিশ্বরূপ দর্শন অধ্যায়টি পুরোই একটা নাটকের অধ্যায় তা প্রমাণ হয় কারণ কৃষ্ণ যখন নিজেই অর্জুন তাহলে ফালতু কেন কৃষ্ণজী অর্জুন কে বিশ্বরূপ দেখাতে গেল ? বলুন কৃষ্ণভক্তরা কৃষ্ণকে ঈশ্বর ভাবলে তো গীতা একটা স্ববিরোধী এবং নাটক পূর্ণ গ্রন্থ হবে তাই না ? আবার দেখুন কৃষ্ণই যখন অর্জুন তাহলে গীতা ২/২ শ্লোকে কৃষ্ণ নিজেই অর্জুনকে অনার্য অর্থাৎ অসভ্য, মূর্খ বলেছে। তাহলে যুক্তিটি তো এই দাঁড়ায় যে কৃষ্ণ নিজেই নিজেকে অনার্য অর্থাৎ মূর্খ, অসভ্য বলেছে ? এমন উল্টো পাল্টা কেন গীতা ? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কি ১০০০০ বছরে খুঁজে পাবেন কৃষ্ণভক্তরা ? বৈদিক শাস্ত্র সম্পর্কে যতদিন অজ্ঞ থাকবে কৃষ্ণভক্তরা ততদিন এই সমস্ত গীতার শ্লোকের যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা হবেনা।
নমস্তে