আমরা যা ভোগ করি তা সবই কি আমাদের কর্মফল ?
আমাদের সনাতনীদের মধ্যে অনেকেই কর্মফল বিষয়ে বিভ্রান্ত রয়েছেন। তারা জানেই না যে স্বীয় কর্মফল কোনটা এবং কোনটা কর্মফল নয়, তাই আজকের যৌক্তিক আলোচনাটি হলো কর্ম ফল ব্যবস্থা বিষয়ক কিছু জিজ্ঞাসার সমাধান।
আমাদের বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী যে জীবাত্মা ভৌতিক শরীরের মাধ্যমে এই জগতে ভোগ করে থাকে তার জন্ম মৃত্যু নেই। জীবাত্মা অজ অর্থাৎ জন্মমৃত্যুরহিত, কিন্তু এই জীবাত্মা হচ্ছে ভোক্তা [শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্ ৪/৫]। ভগবান শ্রীকৃষ্ণও পুরুষকে অনাদি অর্থাৎ যার কোনো আদি নেই মানে যার কখনো সৃষ্টি ধ্বংস নেই এবং পুরুষ বা জীবাত্মা সুখ দুঃখ ভোগ করে এই জগতে। [গীতা ১৩/ ২০,২১] ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন মনুষ্য যেমন পুরোনো বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র ধারণ করে জীবাত্মা ঠিক তেমনি একট জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করে [গীতা ২/২২]। অর্থাৎ জীবাত্মার জন্ম মৃত্যু নেই কিন্তু জীবাত্মা কর্ম ফল অনুসারে নানান জন্ম প্রাপ্ত হয়। আর এই চক্র অনাদি কাল থেকে চলছেই। এর শুরু বা শেষ নেই। অনাদি কাল থেকেই এমন জগৎ সৃষ্টি- স্থিতি- প্রলয়-চলছেই। অনন্ত বার এমন জগৎ সৃষ্টি হয়েছে স্থিতি হয়েছে এবং প্রলয় হয়েছে। কাজেই তো আমরা ধর্ম কে সনাতন, নিত্য শাশ্বত বলে থাকি। মনুষ্য থেকে শুরু করে সকল পশু -পাখি, জলজ প্রাণী, কীটানু আদি এবং উদ্ভিদ আদি পদার্থের মধ্যেও জীবাত্মা রয়েছে। জীবাত্মা একমাত্র মনুষ্য জন্মে কর্মের মাধ্যমে পূণ্য - পাপ উভয় লাভ করতে পারে, মনুষ্য ইতর কোনো জীবের পাপ পূণ্য হয়না, তারা শুধু পাপ কর্মের ফল ভোগ করে নিচু যোনি ভ্রমণ করে থাকে। জীবাত্মা মনুষ্য জন্মে যখন নানান পাপকর্ম করে তখন পশু পাখি আদি নানান নিম্নমানের জন্ম প্রাপ্ত হয়। যথার্থ ভাবে পাপ কর্মের ফল ভোগ করা হয়ে গেলে ঈশ্বরের নিয়ম অনুসারে জীবাত্মা পুনরায় মনুষ্য জন্ম প্রাপ্ত হয়।
য়দাচরতি কল্যাণি শুভম্ বা য়দি বাঽশুভম্
তদেব লভতে ভদ্রে কর্তা কর্মজমাত্মনঃ।।
মনুষ্য যেমন ভালো অথবা খারাপ কর্ম করে ঠিক তেমনই ফল ভোগ করে। কর্তা কে নিজের কৃতকর্মের ফল অবশ্যই ভোগ করতে হয়।
[বাল্মীকি রামায়ণ, অরণ্যকাণ্ড/ ৬৩/৬]
মনুস্মৃতির ১২ অধ্যায়ে কর্ম অনুযায়ী আত্মা কিরূপ জীবদেহ লাভ করে এই বিষয়ে ঋষি মনু সুন্দর ভাবে আলোচনা করেছেন। ঋষি দয়ানন্দও সত্যার্থ প্রকাশের নবম সমুল্লাসে মনুস্মৃতির এই সকল শ্লোক অনুসারে সন্দুর বিশ্লেষণ করেছেন।
সারা বিশ্বের মধ্যে যে সকল ব্যক্তিরা নিজেকে আস্তিক বলে দাবি করেন অথবা মনে করেন স্রষ্টা বলে কেউ আছেন তারা সকলে এই বিষয়ে একমত যে স্রষ্টা ন্যায়কারী, তিনি কখনোই অন্যায় করেন না। এবং আমরা যদি তর্কের দৃষ্টিতে দেখি তাহলেও দেখা যাবে যে সত্তা অন্যায়কারী সে কখনোই জীব জগতের স্রষ্টা হওয়া সম্ভব নয়। অতএব যিনি জীবের সুখ দাতা স্রষ্টা বা পরমাত্মা তিনি অবশ্যই ন্যায়কারী। আমরা সনাতনীরাও বিশ্বাস করি যে ঈশ্বর কারোর প্রতি অন্যায় করেন না, তিনি পক্ষপাতীত্ব রহিত হওয়াতে নিরপেক্ষ ভাবে সকলকে কর্ম অনুযায়ী ফল প্রদান করেন।
যে যেমন কর্ম করবে তাকে তেমন ফল ভোগ করতে হয়, এই কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি কিন্তু এই কর্মফল ভোগ বিষয়ে প্রায়ই লোকের মধ্যে নানান ধরণের শঙ্কা উৎপন্ন হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু শঙ্কা নিম্নলিখিত উল্লেখ করা হলো__
#শঙ্কাঃ মনে করেন একজন মেয়েকে কয়েকজন নিকৃষ্ট কামী ব্যক্তি মিলে ধর্ষণ পূর্বক হত্যা করলো। প্রশ্ন হচ্ছে সেই মেয়েটি কি নিজের কর্মফল পেলেন ? অথবা মেয়েটি এমন কি কর্ম করেছিল যার ফলে হিসেবে তাকে ধর্ষণ হওয়ার পর হত্যা হতে হলো ? মনে করেন একজন ধর্ষক ধর্ষণ করার পর কোনো কারণে সামাজিক দণ্ড থেকে যদি রক্ষা পেয়ে যায়, তাহলে কি এমন ধরে নেওয়া যায় যে ওই ধর্ষকের শাস্তি হলোনা অর্থাৎ এটাই তার কর্মফল ? মনে করেন একজন নিষ্ঠাবান, দানী বিদ্বানকে একজন বিনা দোষে হত্যা করলো, তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় যে ওই ব্যক্তির পূর্ব জন্মে এমন কোনো কর্ম করেছিল যায় ফল হিসেবে এই জন্মে হত্যা হতে হলো অথবা ঈশ্বর কি সেই হত্যাকারীকে প্রেরণা দিয়েছেন কর্মফল দেওয়ার জন্য ? মনে করেন মাতৃগর্ভ থেকে সন্তান প্রসব করার সময় ডাক্তারের কিছু ভুলের জন্য শিশুটির মৃত্যু হলো তাহলে এর জন্য দায়ী কে ডাক্তার নাকি সেই শিশুর মধ্যে থাকা জীবাত্মার পূর্বজন্মের পাপ কর্ম ? নাকি তার বাবা মা ? এমন নানান শঙ্কা উৎপন্ন হয় [যদিও উদাহরণ স্বরূপ কিছু প্রশ্ন তুলে ধরা হলো, কিন্তু এই সকল উদাহরণ গুলো বাস্তবেও ঘটে থাকে, এগুলো কোনো কাল্পনিক উদাহরণ নয়]।
#সমাধানঃ আমরা সনাতনীরা সকলেই বিশ্বাস করি যে কর্ম অনুযায়ী ঈশ্বর সকলকে ফল দান করেন। ঈশ্বর কিভাবে কর্মফল প্রদান করেন এই বিষয়ে শুরুতে বলা হয়েছে। ঈশ্বর প্রতিটি কর্ম করেন নিয়ম করে থাকেন, ঈশ্বর আমাদের জীব দেহে ব্যাপক থেকে কর্ম করছেন ঠিকই কিন্তু তিনি জীবের [জীবাত্মা] কর্মে কোনো প্রকারের হস্তক্ষেপ করেন না। কেননা তিনি জীবকে কর্মে স্বতন্ত্র হিসেবে বানিয়েছেন। এই বিষয়ে পৌরাণিক ও ইসলাম মত খণ্ডন পূর্বক আলোচনাটি দেখার জন্য নীচে থাকা লিংকে প্রবেশ করুন__
https://aryaveeratwa.blogspot.com/2022/12/blog-post.html
যেহেতু নানান যুক্তির মাধ্যমে এইটাই প্রমাণ হয় যে ঈশ্বর জীবের কর্মে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করেন না, সেহেতু বলা যায় যে এই সংসারে আমরা যা কিছু ভোগ করে থাকি, তা সবই কিন্তু আমাদের নিজের কর্মফল নয়, কিছু কিছু ফল অপরের অন্যায়ের মাধ্যমে পেতে থাকি। কোনো এক মেয়েকে ধর্ষণ করার পর তাকে হত্যা করা হলো, তাহলে এখানে মেয়েটি কি নিজের কর্মফল ভোগ করলো ? নাহ, মেয়েটি যা ফল পেলো তা নিজ কর্মের ফল নয় বরং অন্যের [ ধর্ষক ও হত্যাকারী] অন্যায়রূপ কর্মের ফল। একজন দয়ালু নির্দোষ ব্যক্তিকে কেউ হত্যা করলে সেটাও কিন্তু অন্যায় পূর্বক ফল পাওয়া হলো, নিজ কর্মের ফল নয়। ঠিক এমনই ডাক্তারের ভুলে যদি কোনো শিশুর মৃত্যু হয় তাহলে এর জন্য একমাত্র ডাক্তারই দায়ী। ডাক্তারের অন্যায়ের জন্য শিশুটিকে হত্যা হতে হলো। আবার একজন ধর্ষক যদি সমাজের কোনো দুর্বলতার কারণে শাস্তি না পায় তাহলে তো সে সামাজিক আইনের দুর্বলতার কারণে রক্ষা পেয়ে গেল কিন্তু যে জগৎ স্রষ্টার ন্যায় থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। শাস্ত্র অনুযায়ী তাকে মৃত্যুর পর পাপ কর্মের ফল হিসেবে নিকৃত যোনি ভ্রমণ করতে হবে। আমাদের এই বিষয়ে ভালোভাবে আলোকপাত করা উচিত যে জগৎ স্রষ্টা যে কর্মফল দিয়ে থাকে সেটা মৃত্যুর পর। তিনি উত্তম কর্ম করলে উত্তম জন্ম, নিকৃষ্ট কর্ম করলে নিকৃষ্ট জন্ম প্রদান করেন। পৌরাণিক, ইসলাম ইত্যাদি মতানুসারে স্রষ্টা নিজেই অবতীর্ণ হয় পাপীদের ধ্বংস করার জন্য অথবা আল্লাহ কাউকে বাঁদর বানিয়ে দেয়, কাউকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করে ইত্যাদি। তাদের এই মান্যতা সম্পুর্ণ ভ্রান্ত। উপরোক্ত যে লিংকটি দেওয়া হয়েছে সেখানে এই বিষয়ে তার্কিক আলোচনা করা হয়েছে, অবশ্যই দেখে নেবেন। আমরা যা ন্যায় অনুসারে প্রাপ্ত হই সেটাকেই আমাদের কর্মফল বলা উচিত। আমি যদি সমাজকল্যাণে উত্তম কর্ম করে থাকি, এর জন্য যদি আমাকে সকলেই শ্রদ্ধা করে তাহলে এটা আমার কর্মফল, ঠিক তেমনই আমি যদি খারাপ কাজ করে থাকি অথবা অপরের ক্ষতি করে থাকি তাহলে আমার খারাপ কাজের জন্য আমায় যে শাস্তি হবে সেটা আমার কর্মফল। কিন্তু কেউ যদি আমায় অন্যায় ভাবে হত্যা করে তাহলে সেটা আমার কর্মফল নয় বরং সেটা অন্যের অন্যায় কর্মের জন্য আমায় হত্যা হতে হলো। এই জগৎ সংসারে জীব যে সকল কর্ম করবে তার ফল জীবই ভোগ করবে, সেটা ন্যায় পূর্বকও হতে পারে আবার অন্যায় পূর্বকও হতে পারে। এমনও কিছু ব্যক্তি রয়েছে যারা আজীবন লোকের সেবা করে কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে তাদের কেউ সেবা করেনা, সবাই তাদের অবহেলা করে। তখন এইসকল ব্যক্তিরা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলে থাকে "হে ঈশ্বর! আমি আজীবন সকলের সেবা করলাম, কিন্তু এখন আমার কেউ সেবা করে না। সকলকে ভালোবাসার কর্মফল এই দিলে ঠাকুর ?"। এই সব কথা বলা মানে ঈশ্বরকেই দোষী বানানো। এই সকল ব্যক্তি নিজ কর্মের ফল, অন্যের অন্যায়ের মাধ্যমে পাওয়া ফল এবং ঈশ্বরের দেওয়া কর্মফল সম্পর্কে বুঝতে পারে না, তাই তারা এমন বলে থাকে।
অতএব ঈশ্বর যেহেতু মনুষ্য আদি জীব কে স্বতন্ত্র হিসেবে বানিয়েছেন সেহেতু তিনি আমাদের কর্মে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করেননা। আমরা এই সংসারে যে সকল ফল পেয়ে থাকি সেটা নিজের কর্মফল হয়ে থাকে আবার অন্যের অন্যায়রূপ কর্মের ফলও হয়ে থাকে।
0 Reviews:
Post a Comment