জগৎ স্রষ্টা কি যা ইচ্ছে তাই করেন এবং পারেন ?
প্রশ্নঃ ঈশ্বর কি নিয়ম ব্যতীত কিছু করেন ? ঈশ্বর সর্বশক্তিমান তাই যা ইচ্ছে করতে পারে, ঈশ্বরের কর্ম কোনো নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় ?
বর্তমান সমাজে যত সংখ্যক আস্তিক রয়েছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই অন্ধবিশ্বাসী। তারা মনে করেন ঈশ্বর সর্বশক্তিমান তাই সে যা ইচ্ছে করতে পারেন, যে কোনো অসম্ভব কে সম্ভব করা স্রষ্টার কাছে কোনো ব্যাপার নয়।
#পৌরাণিক সনাতনীদের মান্যতাঃ- পৌরণিকদের মধ্যে নানান ভিন্ন ভিন্ন মান্যতা রয়েছে। আমি সেই সব কিছুর বিষয়ে আলোচনা না করে যে অবতারবাদ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সেই বিষয় নিয়ে আজ আলোচনা করবো। অবতারবাদকে সনাতনীরা অন্ধের মতন বিশ্বাস করে থাকে কেননা এটা তাদের ধর্ম গ্রন্থ কথিত ১৮+ পুরাণ কাহিনী অনুকূল। এই মান্যতা অনুযায়ী যখন এই জগতে অধর্ম বেড়ে যায় তখন ঈশ্বর অবতার হয়ে ধর্মের স্থাপন করে এবং অধর্ম ধ্বংস করে। পৌরাণিক শ্রেষ্ঠ ধর্ম গ্রন্থের মধ্যে একটি হলো ভাগবত পুরাণ। আর এই ভাগবত পুরাণ প্রথম স্কন্ধ/ তৃতীয় অধ্যায়/ ৬-২৫ শ্লোক পর্যন্ত ২২ অথবা ২৫ টি অবতারের কথা বলা হয়েছে। কলিযুগে মাত্র দুইটা অবতার- বুদ্ধ ও কল্কি। কলির শেষের দিকে কল্কি অবতার আসবে অধর্ম কে বিনাশ করতে। শুধু বৈষ্ণবদের মধ্যেই নয়, শৈব অথবা শাক্তদেরও নানান অবতার রয়েছে। কেউ যদি বৈদিক শাস্ত্র B ঈশ্বর কে নিরাকার বলে দাবি করে তাহলে তার কথার উত্তরে বলা হয় যে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, তাই সে সব কিছুই করতে পারে। যদি সব কিছু করতে না পারে তাহলে সে কিসের সর্বশক্তিমান ? এমন তর্ক দিয়ে থাকে পৌরাণিক বন্ধুরা।
#ইসলামের মান্যতাঃ- কুরআন অনুযায়ী আল্লাহ সব কিছুই করতে পারে। কুরআন সূরাঃ- ২ বাকারাহ/ ২৪৩ অনুযায়ী আল্লাহ মৃত ব্যক্তিদের জীবিত করতে পারে। কুরআন ৭/১৩৩ অনুযায়ী আল্লাহ নিজেই ফেরাউনের আনসারীদের ওপর তুফান, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত প্রভৃতি দিয়ে আক্রমণ করেছিল। কুরআন ৭/৬৪ এ আল্লাহ বললো অতঃপর তারা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। আমি তাকে এবং নৌকাস্থিত লোকদেরকে উদ্ধার করলাম এবং যারা মিথ্যারোপ করত, তাদেরকে ডুবিয়ে দিলাম। নিশ্চয় তারা ছিল অন্ধ। কুরআন ১৩/২৭ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যে, মনোনিবেশ করে, তাকে নিজের দিকে পথপ্রদর্শন করে। কুরআন ২/৬৫ অনুযায়ী আল্লাহর কথা শুনেনি বলে তাদেরকে ঘৃণিত বাঁদর বানিয়ে দিয়েছিল। আল্লাহ যখন বলেনকুন ফাইয়াকুন অর্থাৎ 'হয়ে যাও' এমন বলার সাথে সাথে হয়ে যায়।কুরআন ৩/৪৭,৫৯। কুরআন পড়লেও বোঝা যায় আল্লাহ সব কিছুই করতে পারে।
#সমীক্ষাঃ বলা যায় যে পৌরণিকদের মান্য ঈশ্বর হোক আর কুরআনের আল্লাহ হোক, স্রষ্টা সব কিছুই করতে পারে, তার কোনো নিয়ম নেই, সে অসম্ভব কে সম্ভব করতে পারে কারণ সে সর্বশক্তিমান। কোনো এক মতবাদের সত্যতা যাচাই করতে গেলে সেই বিষয়ে যৌক্তিক বিচার করা আবশ্যিক, নয়তো কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা তা বোঝা সম্ভব নয়। ঈশ্বর সাকার নাকি নিরাকার সেই বিষয়ে আজ যাবো না। পৌরাণিকদের মধ্যে এক মহান কুযুক্তি প্রচলিত রয়েছে যে 'ঈশ্বর যদি রূপই না ধারণ করতে পারে তাহলে সেই কিসের সর্বশক্তিমান ? ঈশ্বর রূপ ধারণ করে অধর্ম বিনাশ করে'। পৌরাণিক বন্ধুদের এই কুযুক্তির বিরুদ্ধে আমার যুক্তি হলো এই যে আপনার মান্য ঈশ্বর রূপ ধারণ না করলে যদি অধর্ম ধ্বংসই করতে না পারে তাহলে সে কিসের সর্বশক্তিমান ? যদি এটাই সত্য হয় যে পৃথিবীতে যখন অধর্ম বেড়ে যায় ধর্মের গ্লানি হয় তখন ঈশ্বর অবতার হয়ে আছে অধর্ম ধ্বংস করতে এবং ধর্ম স্থাপন করতে। তাহলে জিজ্ঞাসা চলে আসে বর্তমান সময়েও তো ধর্মের গ্লানি অবশ্যই হচ্ছে [ সারা বিশ্বে প্রায় ১১০ কোটি লোকেরা নিজেদের সনাতনী বলে বাদবাকি কেউই সনাতন ধর্ম মানেনা সেই অর্থে পূর্বের চেয়ে এখন অধর্মের বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক বেশি] কিন্তু এখন একটাও অবতার নেই কেন ? যখন ভারতে ইসলাম শাসন ও খ্রিস্টান শাসন হয় প্রায় কয়েকশো বছর ধরে তখন কি ধর্মের গ্লানি হয়নি ? অবশ্যই হয়েছিল। কিন্তু একটাও অবতারের দেখা যায়নি কেন ? যিনি অবতীর্ণ হয়ে অধার্মিকদের ধ্বংস করেছে। যদি বলা হয় 'এখন অবতার আসবে না কলির শেষে কল্কি অবতার আসবে' তাহলে পুনরায় প্রশ্ন তৈরি হবে যে আপনাদের ঈশ্বর তো সব কিছুই করতে পারে, আপনাদের মান্য ঈশ্বর তো কোনো নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ নয় কিন্তু তাকেই আবার নিয়মের মধ্যে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে কেন ? কলিযুগের মাঝে যখন যখন অধর্মের বৃদ্ধি পাবে তখন সেগুলোকে ধ্বংস করার দায়িত্ব আপনাদের ঈশ্বর নেয়নি ? ভাগবত পুরাণ ৩ স্কন্ধের ১৩ অধ্যায় পড়লে বোঝা যায় বরাহ অবতার নিজের দাঁত দিয়ে পৃথিবীকে জলের নিচ থেকে শুরু উপরে তুলেছিল অর্থাৎ বলা যায় যে বরাহ অবতার সুবিশাল রূপ ধরেছিল। এই পৌরাণিক ঈশ্বরের কি এই বুদ্ধিও নাই যে সে যদি বর্তমান সময়ে বরাহ অবতারের সাদৃশ্য কোনো এক রূপ ধারণ করে তাহলেই তো অধর্মের বিনাশ হবে এবং সকলেই পৌরাণিক মান্যতা গ্রহণ করবে, তাই না ? যে ঈশ্বর এতবার অবতার হয়ে আসে অধর্ম ধ্বংস করতে সে ঈশ্বর কি চায়না যে বিশ্বের সকলে তাকে মেনে চলুক ? কিন্তু সে কোনোভাবেই রূপ ধারণ করছে না। এমন নানান যৌক্তিক জিজ্ঞাসার কোনো সমাধান পাওয়া যায় না, কারণ এই অবতারের মান্যতা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং কল্পিত। বিনা যুক্তি তর্কে বিনা বিচারে এই সমাজ অলৌকিক, চমৎকার বিষয়কে ধর্মের অংশ খুবই সহজে মেনে নেয় তাই এই সুযোগ বুঝে সমাজের ভণ্ড লোকেরা ঋষি মুনিদের নামে বই লিখে ছিল, যার কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই। উদাহরণ স্বরূপ বলছি- বর্তমান সময়ে হিন্দু সমাজের একজন বিখ্যাত ধার্মিক হল সৎগুরু। সে যদি এখন এই ধরনের একটা অলৌকিক বই লেখে যে মোদী জি ঋষি ছিল, সে একবার গঙ্গা নদীকে পান করে নিয়েছিল, [ যেমনটা অগস্ত্য ঋষি সমুদ্র পান করেছিল] সে ভগবান ব্রহ্মার অবতার ছিল ইত্যাদি। এমন বই বর্তমান সময়ে কেউ বিশ্বাস না করলেও আজ থেকে ৫০০ বছর পর এমন ব্যক্তি অনেক বের হবে যারা সৎ গুরুর এই বইকে অন্ধের মতন বিশ্বাস করবে এবং মোদী জিকে ব্রহ্মার অবতার ভাববে। ঠিক এমনই ভাবে যোগী, ঋষি, মহর্ষি, রাজা ইত্যাদি মহাপুরুষদেরকে ঈশ্বর বানিয়ে এই সকল কপোলকল্পিত পুরাণ কাহিনী তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ের সত্যতা রয়েছে, যেমনটা মুসলিমদের কুরআনেও ভালো ভালো কিছু বাণী আছে। বর্তমানের আর একটা হাস্যকর বিষয় এই যে মাত্র শত বছরের মধ্যেই অনুকূল ঠাকুর এখন ঈশ্বর হয়ে গেছে, তার এক চ্যালা দেবী দুর্গার থেকেও শ্রেষ্ঠ বলেছে অনুকূলকে। এইভাবে চলতে থাকলে পৌরাণিক সমাজে আগামী ৫০০ বছরের মধ্যে প্রায় এক ডজন ঈশ্বর তৈরি হয়ে যাবে।
#ওদিকে কুরআনের আল্লাহও সব কিছু পারে যারা আল্লাহ কে মানেনা তাদেরকে সে নিজেই শাস্তি দেয়, আল্লাহ মানুষ কে বাঁদরও বানিয়ে দেয়। কিন্তু কুরআনে আল্লাহর যে সব লীলা খেলা রয়েছে তা কিন্তু বর্তমানে আল্লাহ করতে পারছে না। এমন কেন ? যিনি স্রষ্টা তিনি নিজেই শক্তি স্বরূপ, তার নিয়ম সনাতন বা নিত্য হবে। আল্লাহ পূর্বে যা করেছে তা বর্তমানে কেন পারছে না ? যে দেশে ইসলামের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সেই জায়গা এখন শাসন করছে খ্রিস্টানরা। যারা কুরআন অনুযায়ী আহলে কিতাব এবং কাফেরও। উইঘুরে মু*সলিমদের ওপর এতো অত্যাচার করছে আল্লাহ কিছুই করতে পারছে না কেন ? ফিলিস্তিনের ইহুদীরা মু*সলিমদের দাস বানিয়ে রেখেছে তবুও আল্লাহ মৌন কেন ? কিছু মুসলিমরা এই সকল প্রশ্নের উত্তরে বলে থাকে যে আল্লাহ পরীক্ষা নিচ্ছে। আরে ভাই মুস*লিমরা মার খাচ্ছে আর আল্লাহ পরীক্ষা নিচ্ছে মানে ? বিনোদন পূর্ণ কথা বলার আর কোনো জায়গা পাওনা নাকি ? কুরআন ৩৩/২৫এ আল্লাহ বলছে "যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ মুমিনদের জন্যে যথেষ্ট হয়ে গেছেন। আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী"। যে আল্লাহ বলছে যুদ্ধ করার জন্য মুসলিমদের জন্য সে নিজেই যথেষ্ট, সেই আল্লাহ মৌন হয়ে আছে মুস*লিমরা সারা বিশ্বে কাফেরদের হাতে মা*র খাচ্ছে তবুও কেন এখন ? কুরআন অনুযায়ী পূর্বে আল্লাহ যেমন পাপীদের বাঁদর বানিয়ে দিয়েছিল ঠিক তেমনি যদি বর্তমান সময়ে ইসলাম বিরোধী প্রায় কয়েকশ ব্যক্তিকে বাঁদর বানিয়ে দেয় তাহলেই তো সকলে ইসলাম গ্রহণ করবে, তাই না ? কিন্তু আল্লাহ সেটা করতে পারছে না।
#অতএব বলা যায় যে পৌরাণিক মান্যতা এবং ইসলামিক মান্যতা অনুযায়ী ঈশ্বরের যে স্বরূপ আমি তুলে ধরে খণ্ডন করলাম, কে মান্যতার কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই, যে বিষয়ে যৌক্তিক আলোচনা করলে নানান ভুল বেরিয়ে আসে। তা কখনোই প্রকৃত স্রষ্টার স্বরূপ হতেই পারে না।
#সিদ্ধান্তঃ আধুনিক সময়ে ঋষি দয়ানন্দই এমন ব্যক্তি যিনি উক্তি বিষয়ে ঈশ্বরের সঠিক স্বরূপ কে তুলে ধরেছেন। ঋষি দয়ানন্দ বলেছেন ঈশ্বর অবশ্যই সর্বশক্তিমান কারণ তিনি নিজের কর্ম অর্থাৎ জগৎ সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় করতে এবং সর্ব জীবের পাপ পূণ্যের ফল দিতে অন্য কারোরই সহায়তা নেয় না অর্থাৎ তিনি এই সকল কর্ম করতে অন্য কোনো শক্তির সাহায্য নেয়না। কিন্তু পৌরাণিক, মুসলিম ইত্যাদিরা মনে করে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান মানে সব কিছুই করতে পারে এই মান্যতা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। ঈশ্বর পাগল হতে পারে না, ঈশ্বর নিজেকে হত্যা করে অসংখ্য ঈশ্বর বানাতে পারে না, ঈশ্বর মূর্খ হতেও পারে না, ঈশ্বর অন্যায়কারী হতে পারেনা, ঈশ্বর নিজের সর্বব্যাপকতা ধ্বংস করে একদেশী হতেও পারেনা, ঈশ্বর মনুষ্য ইত্যাদি জীবের স্বতন্ত্রতা নষ্ট করতে পারেনা। ঈশ্বর আমাদের জীব দেহে ব্যাপক থেকে কর্ম করছেন ঠিকই কিন্তু তিনি জীবের [জীবাত্মা] কর্মে কোনো প্রকারের হস্তক্ষেপ করেনা, কেননা জীব কর্মে স্বতন্ত্র। স্রষ্টার যদি এইটাই কাজ হতো যে সমাজে থাকা অধার্মিকদের ধ্বংস করা তাহলে কখনোই নিরীহ নারীরা ধর্ষিত হতো না অথবা এই সমাজে কখনোই অসৎ ব্যক্তিদের মাধ্যমে সভ্য ব্যক্তিদের অত্যাচারিত হতে হতো না। এমন নানান কর্ম রয়েছে যা ঈশ্বরের গুণ কর্ম বিরোধী, যেগুলো তিনি করতে পারেন না। পদার্থ বিদ্যা অনুযায়ী আধুনিক বিজ্ঞানীরাও বিশ্বাস করে যে প্রতিটি স্থূল- সূক্ষ্ম কণাও নিয়ম অনুযায়ী চলছে অর্থাৎ বলা যায় যিনি এই জগৎ স্রষ্টা তিনি তার প্রতিটি কর্ম নিয়ম অনুযায়ী করে থাকেন। অসম্ভব কে সম্ভব করা তার কাজ নয়। অতএব যারা বলে থাকে স্রষ্টা সব কিছুই করতে পারে, তাদের মান্য ঈশ্বরের ওপর নানান প্রশ্ন তৈরি হয়, যার কোনো সমাধান সম্ভব নাই অর্থাৎ তারা নিজেদের ঈশ্বর কে ধোঁকাবাজ, মিথ্যাবাদী বানিয়ে দিচ্ছে মাত্র।
নমস্তে